করোনার টিকা আমদানির গতি আরো বাড়ানোর পাশাপাশি দ্রুত দেশেই টিকা উৎপাদনে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে উৎপাদনকেন্দ্রিক প্রক্রিয়া আরো ত্বরিত শেষ করারও পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। যদিও সরকার এরই মধ্যে ইনসেপ্টাসহ আরো কয়েকটি দেশীয় বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চীন, রাশিয়াসহ একাধিক দেশের টিকা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা যায় কি না, সে ব্যাপারে কাজ করছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে। এ ছাড়া সরকার দেশের একমাত্র সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগসের মাধ্যমে ভারতের একটি টিকা দেশে উৎপাদনের ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে আমেরিকা, ইউরোপের প্রবাসী একদল বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে দেশীয় একটি বিশেষজ্ঞদল যুক্ত হয়ে সুইডেনের একটি কম্পানির ন্যাজাল টিকার বাংলাদেশে ট্রায়াল ও উৎপাদন নিয়েও কাজ করছে বলে জানিয়েছেন ওই উদ্যোগের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। এমনকি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও টিকা আমদানি ও টিকাদানের সুযোগ চেয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে আসছে। তবে সরকার এখনো এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার এক সভায় করোনার টিকা বেসরকারি খাতে দেওয়ার যেকোনো উদ্যোগে আপত্তি জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

ওই সভায় বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতকে টিকার সুযোগ দেওয়া হলে অব্যবস্থাপনা বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে আমদানির আগে টিকার মেয়াদ ছয় মাস আছে কি না তা দেখে নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। টিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমদানিতে সরকার এখন যেভাবে সক্রিয়, সেটা খুবই ভালো দিক। কিন্তু আবার টিকা আমদানিতে সমস্যা হলে বিপাকে পড়তে হবে। তাই সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশেই টিকা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করা।

’ এদিকে গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহিরয়ার আলম, নুরুল ইসলাম নাহিদ, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, মো. আব্দুল মজিদ খান, মো. হাবিবে মিল্লাত প্রমুখ। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘কোনোভাবেই বেসরকারি পর্যায়ে টিকা না দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কারণ বেসরকারি খাতে টিকা এলে অব্যবস্থাপনা বেড়ে যাবে।’ ফারুক খান আরো বলেন, ‘আমরা বলেছি, টিকার মেয়াদ কত দিন আছে, সেটা আনার আগে দেখে নিতে হবে।

সেই টিকা আমরা যেভাবেই পাই না কেন, উপহার হিসেবে হোক বা কিনে আনা হোক। এমনও হতে পারে বাংলাদেশে যখন টিকা এসে পৌঁছাবে, সেগুলোর মেয়াদ ১৫ থেকে ২০ দিন রয়েছে। ওই টিকা পরে মাঠ পর্যায়ে যেতে যেতে আর মেয়াদই থাকবে না। তাই এ বিষয়ে আমরা তাদের সতর্ক করে দিয়েছি।’ কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, দেশে এখন চারটি কম্পানির করোনা টিকা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও সিনোফার্ম। গত বুধবার পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে এসব কম্পানির মোট দুই কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার ৯২০ ডোজ টিকা এসেছে। আর গতকাল পর্যন্ত দুই কোটি ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।

বৈঠকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত বিদেশে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের টিকার আওতায় আনার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এদিকে গতকাল রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন আয়োজিত করোনা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ক এক সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘দেশে টিকার ব্যাপক চাহিদার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুতই চীনের সিনোফার্মের ছয় কোটি টিকা কেনার ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। সেই ছয় কোটি ডোজ টিকা কেনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সময়মতো টাকা ছাড় দিয়ে অনুমোদন দিয়েছে।

এখন সিনোফার্মের ছয় কোটি টিকা ধাপে ধাপে দেশে আসতে থাকবে। অন্যান্য মাধ্যমেও আমাদের আশানুরূপ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করছি, দেশে চলমান টিকা কার্যক্রমের গতি চলমানই থাকবে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘পৌনে দুই কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ নিবন্ধন করেছেন। আমরা সবাইকে একবারে টিকা দিতে পারব না। পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিকভাবে টিকা দেওয়া হবে।

’ এদিকে চীনের সিনোফার্মের আরো ১০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত আছে। চীন দূতাবাসের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আজ-কালের মধ্যেই ওই টিকা দেশে আসবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়। এদিকে দেশের সব সিটি করপোরেশন এলাকায় গতকাল মডার্নার টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া শেষ করতে বলা হয়েছিল আগেই।

যদিও গেল মঙ্গলবার থেকেই অনেক কেন্দ্রে ফুরিয়ে যায় মডার্নার প্রথম ডোজের টিকা। এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ শুরু হয়েছে আগেই। অন্যদিকে আগামীকাল শনিবার থেকে সারা দেশে সিনোফার্মের টিকার দ্বিতীয় ডোজ শুরু হবে। সেই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের বাইরে রুটিন টিকার আওতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এত দিন সিনোফার্মের যে টিকা দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে যাঁদের দ্বিতীয় ডোজের সময় হয়েছে তাঁদের নিয়মিত দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে।

পাশাপাশি অক্সফোর্ডের টিকারও দ্বিতীয় ডোজ চলছে কেন্দ্রে কেন্দ্রে। এদিকে বিশেষ ক্যাম্পেইনের আওতায় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে আগামীকাল শনিবার থেকে আবারও সিনোফার্মের প্রথম ডোজের টিকা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তরফ থেকে মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।